সন্ধ্যা নামলেই নির্জনতা ঘিরে রাখতো। গ্রামীণ আঁধার কাটতো কুপি বাতির আলোয়। দুই এক বাড়িতে অবশ্য হারিকেন পৌঁছেছে। গাওয়ের হাট বসতো সপ্তাহে তিন দিন। সোম, বুধ ও শুক্রবার। হাটবার ছিলও বড়দের কাছে প্রয়োজন আর ছানাপোনাদের কাছে বিনোদনের। পিয়াজু, মুড়িমুড়কি খেতে খেলাধুলা কমিয়ে সবার গন্তব্য হাটবার মিস হতো না।
বয়স তখন সাত কি আট। বার কি ছিলও ঠিক মনে নেই। টিলা পথে হাট করে ফিরছিলাম। সন্ধ্যার আঁধারে আলো হারাচ্ছিল। আগে পিছে গাল গপ্পে বাড়ি ফিরছিলও অনেকে। পথের ধারে বাশ ঝাড়ে ঝিঝিদের কানফাটা শব্দের দখলে ছিল প্রকৃতি। কারো কথা ঠাওর করার মতো ছিলও না। তবে মানুষে মানুষে কথা বলার একটা রব এখনও কানে বাজে।
টিলার ঢালে মাটি পথের পাশে বনো সবুজ আলোকিত করছিলও মিটিমিটি জোনাকির ঝাক। সেদিনের জোনাকির আলো আঁধার কাটিয়ে পথ যেন আলোয় চকচক করছিলও। ঠিক যেমন মহাশূন্য আলোকিত করে তারারা। জোনাকির ছোট্ট আলো ঝলক আজও চোখে ভাসে।
সেদিন বড় কষ্টে একটি জোনাক ধরে ছিলাম। মিটিমিটি আলো তারা হাতে সেকি আনন্দ। এখনও অনুভবে সুখ পাই। আলো হাতে ফিরতে ফিরতে অনেকটা পথ পার হয়। দু’হাতের মুঠোয় যত্নে বাড়ি ফিরি। খুশিতে গদগদ। মুঠো খুলিনি জোনাক হারানো ভয়ে। কাছে থেকে দেখার স্বাধও নিতে পারছিনা। দশ, বিশ গুনে মুঠো খুলে দেখি কিছুই নেই। কখন যেন সে উড়ে যায়, বুঝিনি।
আলো হারানো সেদিনের কষ্টকে বড়রা ছেলেমানুষী বলে তুচ্ছ করেছিলেন। কিন্তু মাঝ বয়সে এসেও নিজের কাছে সেই স্মৃতি অমূল্য। ছোটতার, ছেলেমানুষীর সেদিনে এখনও ফিরতে চাই। কিন্তু সে সুযোগ কই, স্মৃতি ছাড়া। এখন কেবলই অন্য এক ফেরার তাগাদায়।
রাতের কালো, রঙের আলোয় চকচক এখন। গ্রামীণ মাটি পথ এখন বিটুমিনে মসৃণ। গতিতে বিশ্ব বাজারের নামি দামি গাড়ি চলে। টিলার ঢালের বাশ ঝাড় নেই। উজাড়, নির্বংশ প্রায়। ঝিঝিরা শব্দ হারিয়ে বোবা হয়ে গেছে। প্রকৃতির সাথে পাল্টেছে গ্রাম সভ্যতা, রীতিনীতি। এখন নির্দিষ্ট দিনে হাট বসে না। পুরো গ্রামই যেন হাট। সবখানে দোকান। সবদিনই হাট বার, বাজার।
জোনাকিদের বিচরণ ক্ষেত এখন বিদ্যুৎ খুটির দখলে। তারারা মহাকাশে এখনও আলো দিলেও জোনাকিরা চলে গেছে ভিন দেশে, আঁধার কালো নির্জন কোনো গ্রামে। তোমরা ফিরে আসো। না হয় আমাকেই যেতে হবে, স্মৃতি চড়ে।
৭ জুলাই ২০২৩