মেহনি (Meehni), উইমলা (Wimlah) ও গুনেডু (Gunnedoo) এরা তিন বোন। সৌর্ন্দয্য অতুলনীয় ছিলও তারা। তাদের নিয়ে নানা পৌরানিক গল্প আছে দ্বীপ মহাদেশ অস্ট্রেলিয়ার আদি ইতিহাসে। আদিমকালের এই ত্রয়ীর গল্প রহস্য ঘেরা। সুন্দরী রূপবতি এই ত্রয়ীর প্রতিবেশি ছিলও উপজাতি এক পরিবারে তিন সহোদর। তাদের নাম-দাম ইতিহাসে আজও অজানা। তবে, তাদের বসবাস ছিলও নীল পর্বতমালায় (Blue Mountains)। পৌরানিক গল্পের অজানা নায়করা আদিমতায় হারিয়ে গেলেও, সুন্দরী তিন বোনের এখনও দৃশ্যমান। নীল পর্বতে পাথর রূপে তারা এখনও অমলিন। শুধু বদলেছে গায়ের আবরণ। তারা এখন পাথুরে আকৃতি নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে আছেন!
অস্ট্রেলিয়ার পৌরানিক গল্প অনুসারে, মেহনি, উইমলা ও গুনেডু- রূপবতি তিন বোন নীল পর্বতের বাসিন্দা উপজাতি তিন সহোদরের প্রেমে পড়েন। তাদের প্রেমের সর্ম্পক জানাজানি হয়। অসম প্রেম কাহিনী বলে খ্যাত হয় তাদের সে সর্ম্পক। তখনকার সময়ে উপজাতি সংস্কৃতির রীতিনীতিতে যা ছিলও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ৩ বোনের প্রেমের করুণ উপাখ্যান তৈরী হয়। মধুরতম প্রেমের বদলে সৃষ্টি হয় এক রক্তক্ষয়ি প্রেমকাহিনী। পর্বত জুড়ে বেদনার করুণ সুর উঠে।
কি হয়েছিলও তখন? নীল পর্বতের বাসিন্দা মেহনিদের প্রেমে প্রাথমিক জয় হয়েছিল প্রতিবেশী উপজাতি গোত্রের তিন সহোদরের। কিন্তু প্রথা বিরোধী হওয়া ভিন্ন গোত্রের মানুষের সাথে সর্ম্পক বাঁধার মুখে পড়ে। কিন্তু প্রেম কি বাঁধা মানে? মানে না। তাই তিন সহোদর মেহনিদের জোর পূর্বক উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্ঠা করেন। এই ঘটনায় দুই গোত্রের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাঁধে!
বেদনার নীলে ঘিরে যায় পুরো পর্বতমালা। চারপাশের পাহাড়গুলো নীলাকার হয়ে উঠে। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের আর কোথাও নীল পাহাড় নেই। অজিদের বিশ্বাস- মেহনিদের বেদনার প্রতিক হয়ে পৃথিবীকে স্বাক্ষ্য দিচ্ছে নীল পর্বতের পাহাড়গুলো। নীল পর্বতের জেসমিন ভ্যালির চুঁড়ায় পাথুরে যে তিনটি ক্ষয় প্রাপ্ত পর্বত খন্ড দেখছেন এরাই অস্ট্রেলিয়ার পৌরানিক গল্পের তিন বোন! যা এখন থ্রি সিস্টার্স নামে পরিচিত। এটি বর্তমানে সিডনির বিখ্যাত একটি পর্যটন কেন্দ্র।
আদিম থেকে আধুনিকতায় মেহনিরা উজ্জ্বল হয়ে উঠেন। নিজেদের সৌন্দর্য্য বিলিয়ে ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছেন পাথুরে ত্রয়ী। তিন বোনের প্রেমের শেষ পরিনতি হয়ে থাকলো থ্রি সিস্টার্স। তাদের প্রেমের করুন সুর এখনও বিশ্ব হৃদয় কাঁদায়। বিশ্বের যেকোন প্রান্ত থেকে ভ্রমনকারী সিডনি আসলে থ্রি সিস্টার্স দেখতে ভুল করেন না। মুগদ্ধ হন পাথর হয়ে যাওয়া মেহনিদের সৌর্ন্দয্যে। আমিও দেখে সেই বেদনার নীল, নীলা পর্বত চুঁড়া।
থ্রি সিস্টার্স-এর প্রাকৃতিক গঠণ
থ্রি সিস্টার্স-এর অবস্থান অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের কাটুম্বা শহরবর্তি নীল পর্বতমালার জেমিসন ভ্যালিতে। প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে ‘ট্রায়াসিক’ আমলে ভূমি ক্ষয় হয়ে গড়ে উঠে ‘থ্রি সিস্টার্স’ (Three Sisters)। নীল পর্বতমালার বেলেপাথর প্রচন্ড বাতাস, ভারি বৃষ্টি আর পর্বতমালার খরস্রোতা নদীর তুড়ে ক্ষয় হতে শুরু করে। সেসময় জেমিসন উপত্যকার চারপাশের পর্বতগুলোতে ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দেয়। এক পর্যায়ে পর্বতমালার অংশ বিশেষ সমুদ্র জলে তলিয়ে যায়। প্রাকৃতিক সেই গঠন-পূর্ণগঠনে মহাসাগরের তলে একটি পলল স্থর গড়ে উঠে। সেখানে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট উপাদান সমূহ ভূমিক্ষয় প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয়ে বেলেপাথরে রূপ নেয়। এক সময় সেই বেলেপাথরের স্থরে শক্তিশালী আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হয়। এর ফলে পর্বতমালায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়। থ্রি সিস্টার্স সেই পারিবর্তনেরই এক রূপ।
থ্রি সিস্টার্স এর উচ্চতা অনুযায়ি তিন বোনের নামে নামায়ন করা হয়। ৩০২৫ ফুট উচ্চতার পাথরটির নাম মেহনি (Meehni)। উইমলা’র (Wimlah) উচ্চতা ৩০১২। ফুট আর গুনেডু’র (Gunnedoo) উচ্চতা ২৯২৮ ফুট। রুক্ষ পর্বতমালার আর্শ্চয্য এই প্রাকৃতিক দৃশ্যে দেখতে প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ভ্রনম পিপাসুরা আসেন। ৩৯০০ ফুট উচ্চতার নীল পর্বতের পিক পয়েন্ট থেকে এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়।
এখানে আসলে রুক্ষ খাড়া পর্বত চুড়ায় মেঘের দৌড়ানি দেখে যেকেউ মুগদ্ধ হবেন। পর্বতমালার দূর সীমানায় সূর্য্যালোকের পরিবর্তনের ফলে রূপ বদলায় ক্ষনে ক্ষনে। একইভাবে থ্রি সিস্টার্সে রূপ রং বদলায়। একেক আলোয় একেক রূপে ধরণ করে। তবে, মেঘলা আবহাওয়ায় এখানকার পরিবর্তন ভ্রমনার্থীদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষনীয়। এছাড়া, খাড়া রুক্ষ পাহাড়, ইউক্যালিপটাস বন, জলপ্রপাত, পাহাড়ী গ্রাম দেখার অভিজ্ঞতা নিতেই পারেন যেকোউ। সেক্ষেত্রে অবশ্য নীল পর্বতের অন্তত একরাত থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হবে।
সিডনি থেকে নীল পর্বত যাবেন কিভাবে?
রেল, বাস ও প্রাইভেট কারে যেতে পারেন সিডনি শহর থেকে ১১২.৬ কিলোমিটার দূরত্বের পর্যটন কেন্দ্রে। ট্রেনে দেড়’শ অস্ট্রেলিয়ান ডলার খরছে ট্রেনে যেতে সময় লাগবে আড়াই থেকে ৩ ঘন্টা। একই পরিমান সময়ে বাসে যেতে খরচ হবে একশ ত্রিশ থেকে একশ চল্লিশ ডলার। তবে সময় বাঁচাতে চাইলে প্রাইভেট কার ভাড়া করে দেড় ঘন্টায় পৌছাতে পারেন।
আব্দুল আলিম শাহ | সিডনি, অস্ট্রেলিয়া