shape
Published

July 19, 2023

No Comments

Join the Conversation

View

368 Views

সিডনির রৌদ্রজ্জ্বল সকালে গরম চায়ে চুমুক দিতে ভাবছিলাম কোথায় ঘুরতে যাবে।  ক’দিন সঙ্গ দিয়েছেন বন্ধু সহকর্মী শাহাব উদ্দিন শিহাব। আজর তিনি কর্মস্থলে ব্যস্ত। তাই আজ একাই বেরিতে হবে। ক্যান্টারবেরি-ব্যাঙ্কটাউনের লাকাম্বা ট্রেন স্টেশন থেকে ৫৫ মিনিটের পথ সিটি অব সিডনির ম্যাককুয়ারি স্ট্রিট-১ শেক্সপিয়ার পেলেসে রওয়ানা হলাম। ট্রেনে যেতে পথে বানিজ্যক শহর সিডনির গোছানো, সাজানো নগরায়ন দেখছিলাম।

১২ হাজার ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটারের পরিকল্পিত বর্ধমান এই শহর ঘুরে বেড়াতে সড়ক যোগাযোগ, ট্রেন যোগাযোগ, নৌ পথ এমনকি আকাশ পথও হাতের নাগালে। ট্রেনের জানালায় বসে দেখেছি কয়েকটি হেলিকপ্টারের উড়া উড়ি। ২৪০ থেকে ২৫০ অস্ট্রেলিয়ান ডলারে সিডনি শহর উড়ে বেড়ানো যায়। নগরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রেনে চড়ে গন্তব্যে পৌছাই। প্লাটফর্মের ডিজিটাল ডিসপ্লেতে চোখ বুলিয়ে ম্যাককুয়ারি স্ট্রিটে বের হই ভূগর্ভস্থ প্লাটফর্ম থেকে। 

প্রথমেই স্ট্রিটের চত্ত্বরে দৃষ্টি আটকায় ভিক্টোরিয়ার স্টেচ্যুতে। ফটো সেশন করে এগিয়ে যাই ৪০০ মিটার অদূরে গন্থাগারের প্রবেশ মুখে। দুপাশে সড়ক। মাঝখানে সেক্সপিয়ার যেন আগতদের স্বাগত জানাচ্ছেন। হেনরী গুলেট (Henry Gullett) ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে এটি স্থাপন করেন। ছ’টি সুউচ্ছ খিলানের ছাউনি তলে প্রবেশদ্বারে আগত যেকেউ সম্ভাষন পাবেন স্থাপথ্য ভাষায়। গণ গ্রন্থাগারে প্রবেশ করলাম। বিশাল পড়ার ঘর। চারিদিকে বই আর বই। শত পাঠক, গবেষক টেবিলে টেবিলে। দ্বিতল কক্ষের দেয়াল ঘেষা সিঁড়ি। উপরের বইগুলোও যেন সহজে পরখ করতে পারেন পাঠকরা। নিস্তবদ্ধ, নিরবতায় পড়ুয়ারা মগ্ন। আমি রেকে রাখা বইগুলো দেখতে ধীরে ধীরে হাটছি। মেজেতে মখমল বিছানো। তবুও যেন পায়ের শব্দ কানে আসছে। হাজারে হাজার বইয়ে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। 

কোথায় কি আছে দেখতে অর্থ্যাৎ একনজর দেখে নিলাম বই রাজ্য। কোন কোন বই নেই এখানে? বিস্মিত। এতো বড় বইয়ের রাজ্য আমি আগে দেখিনি। আগেই যেনে নিয়েছিলাম, এখানে ফ্লাস লাইট ছাড়া ছবি, ভিডিও তোলা যাবে। তাই দু একটা ছবি তোলে নিই। এবার সেক্সপিয়ার গ্যালারীতে। উলিয়াম সেক্সপিয়ারের আবক্ষ মুর্তি দিয়ে প্রবেশদ্বার সাজানো। ছবি, লেখাজুখা কতো বিরল সব উপস্থাপনা। গ্যালারী ঘুরে দেখতে যেকোন পর্যটকের অনন্ত ঘন্টাখানেক সময়তো লাগবেই। আমি প্রবেশ করেছিলাম সাড়ে বারোটায়। শুধু একপল দেখে দেখে বেরিয়েছি বিকেল সাড়ে চারটায়। শুধুমাত্র পড়ার ঘর আর গ্যালারীতে কেটেছে পুরোটা সময়।

দেখেছি শত শত বছরের পুরোনো ইতিহাসের নিদর্শন সমূহ। অস্ট্রেলিয় সংস্কৃতির আদিকাল থেকে আধুনিক। সিডনি ভ্রমনে এসে গ্রন্থাগারে না আসতে পারলে ঠকে যেতাম। পড়ন্ত বিকেলে গ্রন্থাগার থেকে বেরিয়ে আসি। তখন প্রচন্ড খিদে। সড়কের ওপারে যাই, খাবারের দোকানে। ততক্ষনে পাচঁটা ছুঁই ছুঁই। দোকানিদের বেলা শেষ। ব্যবসা বন্ধের তাড়াহুড়ো চলছে। বইয়ের গন্ধে সারাদিন খাবোরের কথা মনে না পড়লেও এখন যেন তর সইছে না। কয়েকটি দোকানে খোঁজাখুজির পর ভ্রাম্যমান গাড়িতে সিঙ্গেল শট এক্সপ্রেসোতেই মুখ বদলাই। ভিক্টোরিয়া স্টেচ্যুর সামনের বিশাল বৃক্ষ তলে কফি কাপেই সন্ধ্যা নামে। সামনে কতো মানুষের দৌড়ঝাপ। গাড়িতে, ট্রেন স্টেশনে যাবার তাড়া। সবই দেখছি, কিন্তু ঝাপসা। চোখে গ্রন্থাগারের আবেশটা যেন যাচ্ছেই না। হয়তো দেখা নয়; নিয়ম করে প্রতিদিন একবার পড়ার ঘরে আসলেও বইয়ের বিশাল এই রাজ্য জয় সম্ভব নয়। তৃষ্ণা রেখেই ফিরলাম। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে কেউ যদি ভ্রমনে আসেন, আপনার ভ্রমন তালিকায় ‘পাবলিক লাইব্রেরী অব নিউ সাউথ ওয়েলস’ রাখবেন। নিশ্চিত করেই বলছি- ঠকবেন না। জিতেই ফিরবেন। 

গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা

‘অস্ট্রেলিয়ান সাবস্ক্রিপশন লাইব্রেরী (Australian Subscription Library) ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে পিট স্ট্রিটে (Pitt Street) ভাড়া ভবনে এর যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী দুই বছর গ্রন্থাগারটি ভ্রাম্যমান সেবা প্রদান করে। পরে বেশ কয়েক বছর জর্জ স্ট্রিটে, ব্রিজ স্ট্রিট, ম্যাককুয়ারি স্ট্রিট এবং ম্যাককোয়ারি প্লেসে গ্রন্থাগারটি স্থানান্তরিত হয়। শেষমেষ ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বেন্ট এবং ম্যাককুয়ারি স্ট্রিটের (Bent and Macquarie Streets) নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হয়। অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীনতম গ্রন্থাগার ‘নিউ সাউথ ওয়েলস স্টেট লাইব্রেরী’। নানা সমস্যায় গ্রন্থাগারটির অচলাবস্থায় পড়লে ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে নিউ সাউথ ওয়েলস সরকার ‘অস্ট্রেলিয়ান সাবস্ক্রিপশন লাইব্রেরীটি (Australian Subscription Library) কিনে নেয় এবং নামকরণ করা হয় পাবলিক লাইব্রেরী অব নিউ সাউথ ওয়েলস/দি স্টেট লাইব্রেরী অব নিউ সাউথ ওয়েলস (The State Library of New South Wales)। দেশের প্রথম এই গ্রন্থাগারটি দুই হাজার পুস্তক নিয়ে নব যাত্রা শুরু করে। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় গ্রন্থাগারটির উন্নয়ন করা হয়। মিচেল উইং ও ডিক্সন উইং নামের দুটি ভবনে বিস্তৃত হয় এটি। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রিন্স ফিলিপের ( Prince Philip) সাথে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ (Queen Elizabeth-II) গ্রন্থাগারটির নতুন সংযোজনের উদ্বোধন করেন। স্থপতি মি.  অ্যান্ড্রু অ্যান্ডারসন (Mr Andrew Andersons) এবং ওয়াল্টার লিবার্টি ভার্নন (Walter Liberty Vernon) ছিলেন গ্রন্থাগারটির স্থপিতি। এখানে রয়েছে প্রদর্শনী গ্যালারী, রিডিং রুম, বইয়ের দোকান, শেক্সপিয়ার রুম, লাইব্রেরী ক্যাফে, ফ্রেন্ডস রুম, ও লাইব্রেরী বার। বিভিন্ন গ্যালারীতে ১২ ৭৬ টি পেইন্টিং, মানচিত্র রয়েছে ৩০২টি এবং ২৪ ৭৩৫টি ছবি সংগ্রহে রয়েছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, গবেষনা, বিশ্বযুদ্ধ সহ নানা বিষয়ে বিশাল সংগ্রহ গ্রন্থাগারটিকে সমৃদ্ধ করেছে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ও প্রাচীনতম পার্লামেন্ট

আপনার হাতে সময় থাকলে একই দিনে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ও প্রাচীনতম পার্লামেন্ট দেখে আসতে পারেন। সকাল ৯ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। গণগ্রন্থাগারের পরেই সিডনি হাসপাতাল, এর পরের ভবনটিই ঐতিহাসিক ‘দি রাম হসপিট্যাল’। আপনি নিজের পরিচয় দিয়ে নির্ধারিত নিরাপত্তা চৌকি পেরিয়ে পার্লামেন্টে প্রবেশ করতে পারেবন। ইনফরমেশন ডেস্কে পার্লামেন্ট সর্ম্পকিত সকল তথ্য পাবেন।

আমি পার্লামেন্ট ভবনের বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইছিলাম। ফলে আমাকে একজন কর্মকর্তা পুরো ভবনের কোথায় কি আছে ঘুরে দেখান এবং বিষদ বর্ণনা করেন। তবে, পার্লামেন্টের আভ্যন্তরিক কিছু আইন কানুনের কারণে আমি সব কক্ষে প্রবেশানুমতি পাইনি। ১৯ জুলাই ২০২৩ তারিখে নির্ধারিত কোন সভা না থাকায় ঘুরে দেখাটা সহজ হয়। এখানে ভ্রমনের ক্ষেত্রে কোন ধরণের ফি প্রদান করতে হয় না। পার্লামেন্ট কার্যালয়ের কর্মকর্তারা খুবই আন্তরিক। তারা আপনার এবং আপনার দেশ সর্ম্পকে জানতে চাইতে পারে।

নিউ সাউথ ওয়েলসের পার্লামেন্ট। এটি অস্ট্রেলিয়ার প্রথম এবং প্রাচীন পার্লামেন্ট। প্রতিষ্ঠাকালীন ভবনের কিছু অংশ এখনও সংরক্ষিত আছে। সিডনিতে ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। নিউ সাউথ ওয়েলসের তৎসময়ে গভর্নর ছিলেন লাচলান ম্যাককুয়ারি (Governor Lachlan Macquarie)। তখনও এখানে স্থায়ী হাসপাতাল সুবিধা ছিলও না। তিনিই সিডনিতে প্রথম স্থায়ী হাসপাতাল পরিচালনা করেন, এর কার্যক্রম শুরু ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে। হাসপাতালটি নির্মাণ করতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ষাট হাজার গ্যালন ‘রাম’ আমদানি ও বিক্রির অনুমতি দেয়া হয়। এ কারণে হাসপাতালটির নামকরণ করা হয় ‘দ্য রাম হসপিট্যাল’।

প্রতিষ্ঠাকালীন মূল ভবনের দুটি অংশ টিকে আছে যা বর্তমানে নিউ সাউথ ওয়েলস-এর পার্লামেন্টের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে শাসকরা গভর্নরকে সহায়তা করতে এ রাজ্যে একটি আইনসভা গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি ছিলও নিউ সাউথ ওয়েলস-এর গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার প্রথম ধাপ। ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত। সে সভায় পাঁচ সরকারী কর্মকর্তা অংশ নেন। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে আইনসভা বর্ধিত করা হয়। নিউ সাউথ ওয়েলসে গণতন্ত্রের বিকাশ ও পার্লামেন্ট ভবনের কার্যকর ভূমিকা রাখতে করে। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে পূনঃনির্মাণ করে ১২ তলা বিশিষ্ঠ ভবনে রূপান্তর করা হয়। বর্তমান পার্লামেন্টে বিধানসভা, আইন পরিষদে রাজ্যের ৯৩টি জেলার প্রতিনিধি রয়েছেন এবং ২৩ জন মন্ত্রী সরকারের দায়িত্ব পালন করছেন।

 

আব্দুল আলিম শাহ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

Author

Share On:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *