ভোর হতো তাদের গল্প শুনে। ভালোবাসার গান শুনে। জানলার পাশে আতা ফলের গাছ। পাঁকা আতার পাশে বসেই মিষ্টি কন্ঠে সুর বাঁধতো তারা। একটি সুখি পারিবার। ঘরের কার্নিশে বসতি ছিলো ক’টি টুনটুন পরিবারের। তারাও জাগতো সুরে লয়ে। সুরে উত্তাল আধারি উঠান। কথনো মধুর, কখনো রাগ বইয়ে যেতো তাদের গান-সুরে। ভাষাভাষি না হওয়ায় সেটি অনুমান করা যেতো না। তবে মনে হতো সংসার জীবনের কষ্ট বেদনার গানও গাইতো তারা। ভালোবাসার মিষ্টি আলাপ তো হতোই। পশ্বিমে হাওর, পূবে বিল। দক্ষিনে নদী, উত্তরে টিলা পাহাড়ের গাওয়ে আমার বসত টিলার ভোর-সকালের সাথি ছিলো তারা। স্বজন বলতে ছিলো- লাল কাঠাল, সাদা কাঠাল, জারুল, দীর্ঘদেহি চাউর আর চাটনী গাছ। বাতাশের গায়ে বাঁশি বাজানো বাঁশ বাগান ছিলো বাড়তি উম্মাদনার। ভোর থেকে রাত, সারাবেলার আবহ সঙ্গিতালয়। মুধুরতম সেইসব ভোর-সকালের গল্পের সাক্ষি এখনো ভোরের রি রি বাতাস।
বসতির মানুষেরা তখনো ঘুমিয়ে। পাখিদের সুরের মুর্ছনায় ঘুম পর্বের সমাপ্তি টানবো সবাই। গল্প-গানের মধুরতায় আমাদের ঘুম ভাঙ্গতো না, কিন্ত হৃদয় জাগতো। কতো গান। কতো গল্প। মক্তবের মুয়াজ্জিন চুঙ্গায় আজানের ধ্বনি ফুকেননি, পাল বাড়ির পূজোর ঘন্টা বাঝেনি তখনো। কিন্তু গান-গল্পের সুরে জলসায় ঘরে পরিনত টিলা বাড়িটি। মানুষ, গাছ, পাখি আর তাদের গান-গল্পের ভোরটা এমনই ছিলো। মুধুরতম সেইসব ভোর-সকালের স্বাক্ষী এখনো সূর্য্যালোক।
ভোরের আধোয়ালোয় পূব দেওয়ারের দীর্ঘ চাটনী গাছের পাতারা কুয়াশার জলে শীতে কাঁপাতো। হালকা সবুজ, নুয়ে পড়া পাতাদের সকাল হতো পূবালি আলোর ছুঁয়ায়। রাত জেগে এগাছ, ওগাছ থেকে ফলাদি খেয়ে বেড়ানো ক্লান্ত পাখিরা তখন ঘরে ফেরায় ব্যস্ত হয়ে পড়তো। দলে দলে, জোড়ায় জোড়ায় তরস্ত ড়ে যাওয়ার শব্দ শোনা যেতো ঘুম ঘর থেকে। তখনো আমরা জাগিনি। মুধুরতম সেইসব ভোর-সকালের গল্প এখনো ফকির বাড়ির মাটিতে জমা আছে। ভুল পড়ছে কেবল স্মৃতিতে।
গ্রাম্য সরল মানুষ গুলোর অনেকে এখন নগরে থাকি। নগরে ঘুমাই। জাগি যাতি-যন্ত্রের শব্দের বিকট শব্দে। এখন আমরা সুখের ‘নাগরিক’। বছরে কখনো সখনো হয়তো পাখি দেখি, গান শুনিই না। পাখির গানে ঘুম ভাঙ্গার অভ্যেস সেকেলে হয়েছে সেই কবে। সিসা যুক্ত বাতাসে ভোরের আলো ফুটে এখন। মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি শুনি বিকট শব্দে, বৈদ্যুতিক মাইকে! আজানের চুঙ্গা এখন যাদু ধরেও নেই, অনুমান।
সুখ স্মৃতিরা কেবল দূরের বরফ পাহাড়ে চাপা পড়ছে। আর আমরা হারিয়ে যাচ্ছি সময়ের কিনারে। পড়ে গেলেই সমাধিস্থ হবো, মুধুরতম সেইসব ভোর-সকালের গল্প সহ।
ফকির পাড়া, দক্ষিণ বাঘা, বাঘা, গোলাপগঞ্জ, সিলেট