shape
Abdul Alim Shah February 16, 2024 No Comments

নগর জংলায় বনবাসী

জংলার সুর! কি মধুর! সুমধুর সুরে ভোর হয়। সন্ধ্যা মাতোয়ারা হয় সেই সুরের মূর্ছনায়। কান ভরে শুনি, কান পাততে হয় না। অচেনা সব শিল্পী। কন্ঠরাও নয়া। কিন্তু সুরগুলো বড় আপন, চেনা জানা। ঘুম ভাংগে তাদের গল্প-গানে। আমি সময় গুনি সন্ধ্যার আসায়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। গানের মহড়া শুরু হয়। বাতাস ফুরায়, উত্তরের হাওয়া দক্ষিণে বয়। উম লাগা হাওয়ায় শীতলতা আসে। কিন্তু গানওয়ালাদের সুর ফুরায় না। তবু্ও অতৃপ্ত রই, জংলার বনবাসে। বনে উড়ু মন প্রশান্তিতে ক্লান্ত হয়ে আসে। নির্জন নিস্তব্ধ রজনী কাটে বাতাসের গায়ে হেলান দিয়ে। বাতাসে গল্প উড়ে, সুর ভাসে। কতো সুর, কতো ভাষার কতো কথা। কখনো একলা, একা গায়। রাত গভীরে দুকলাও গায়। দলে দলে সুর মিলিয়ে কোরাসও গায়। বিরামহীন গেয়ে যায় গায়েনরা। তারা নাগরিক কোলাহল তোয়াক্কা করে না। শ্রোতাদের ভীড় প্রত্যাশা করে না। ক্লান্ত হয় না মোটেও। তারা শিল্পী, শিল্প বিলায়। একলা এক শ্রোতা! আমার জংলায় বাস। পড়শী যারা, তারা পাখি, পশুও। জংলার বনবাসী। আমি গান শুনি, গল্পও। ভালোবাসি গান, আপ্লুত হয় গল্পে। মধুরতম সুরের মায়ায় মাতম করি, নগর জংলায় বনবাসী হয়ে।

Abdul Alim Shah February 14, 2024 No Comments

শোকের জোয়ার, ভাটায় সুখ

একটা সায়র আছে, জল হীন। যেখানে শোকে জোয়ার আসে, ভাটায় সুখ। ভালোবাসি কি জানি? যদি না বলি তবে, হয়তো এখনো বুঝিনি। জীবনের সূচিতে দিন ধরে হয়তো ভালোবাসা হয়নি। শনিবারের ভালো লাগা বুঝতে হয়েছে শুক্রবার। জনের ভালোবাসা কতোজনে ঠেকেছে? ক্ষনে-খানে ভালোবাসা হারিয়েছে। আটকে আছে আলো, জোছনায়। ভালোবাসার দেনা আছে। পাওনাও কম না। সুদ, আসল, লাভের হিসেবে গরমিল আছে। এখনো ভালোবাসা কিসে, বুঝিনি। তার আগেই হয়তো সময়ের হিসেব মিলে যাবে। ভালোবাসার ঋন সুধিবার সুযোগ ফুরিয়ে যাবে। হৃদ উঠান থেকে উড়ান দেবে দম। মিশে যাবে সময়ে, শনি থেকে শুক্রবারে। হয়তো পৌষ কিংবা মাঘে। অথবা বারিষায়। মা ছেড়ে মিলে যাবো মাটিতে। তখনো ভালোবাসা ভিক্ষে পাবো জনের জানে, ক্ষনে-খানে। ভালোবাসা সবার জন্য।, আমার জন্যে

সময়ের কিনারে, পড়ে গেলেই সমাধিস্থ হবো স্মৃতি সহ

ভোর হতো তাদের গল্প শুনে। ভালোবাসার গান শুনে। জানলার পাশে আতা ফলের গাছ। পাঁকা আতার পাশে বসেই মিষ্টি কন্ঠে সুর বাঁধতো তারা। একটি সুখি পারিবার। ঘরের কার্নিশে বসতি ছিলো ক’টি টুনটুন পরিবারের। তারাও জাগতো সুরে লয়ে। সুরে উত্তাল আধারি উঠান। কথনো মধুর, কখনো রাগ বইয়ে যেতো তাদের গান-সুরে। ভাষাভাষি না হওয়ায় সেটি অনুমান করা যেতো না। তবে মনে হতো সংসার জীবনের কষ্ট বেদনার গানও গাইতো তারা। ভালোবাসার মিষ্টি আলাপ তো হতোই। পশ্বিমে হাওর, পূবে বিল। দক্ষিনে নদী, উত্তরে টিলা পাহাড়ের গাওয়ে আমার বসত টিলার ভোর-সকালের সাথি ছিলো তারা। স্বজন বলতে ছিলো- লাল কাঠাল, সাদা কাঠাল, জারুল, দীর্ঘদেহি চাউর আর চাটনী গাছ। বাতাশের গায়ে বাঁশি বাজানো বাঁশ বাগান ছিলো বাড়তি উম্মাদনার। ভোর থেকে রাত, সারাবেলার আবহ সঙ্গিতালয়। মুধুরতম সেইসব ভোর-সকালের গল্পের সাক্ষি এখনো ভোরের রি রি বাতাস।  বসতির মানুষেরা তখনো ঘুমিয়ে। পাখিদের সুরের মুর্ছনায় ঘুম পর্বের সমাপ্তি টানবো সবাই। গল্প-গানের মধুরতায় আমাদের ঘুম ভাঙ্গতো না, কিন্ত হৃদয় জাগতো। কতো গান। কতো গল্প। মক্তবের মুয়াজ্জিন চুঙ্গায় আজানের ধ্বনি ফুকেননি, পাল বাড়ির পূজোর ঘন্টা বাঝেনি তখনো। কিন্তু গান-গল্পের সুরে  জলসায় ঘরে পরিনত টিলা বাড়িটি। মানুষ, গাছ, পাখি আর তাদের গান-গল্পের ভোরটা এমনই ছিলো। মুধুরতম সেইসব ভোর-সকালের স্বাক্ষী এখনো সূর্য্যালোক। ভোরের আধোয়ালোয় পূব দেওয়ারের দীর্ঘ চাটনী গাছের পাতারা কুয়াশার জলে শীতে কাঁপাতো। হালকা সবুজ, নুয়ে পড়া পাতাদের সকাল হতো পূবালি আলোর ছুঁয়ায়। রাত জেগে এগাছ, ওগাছ থেকে ফলাদি খেয়ে বেড়ানো ক্লান্ত পাখিরা তখন ঘরে ফেরায় ব্যস্ত হয়ে পড়তো। দলে দলে, জোড়ায় জোড়ায় তরস্ত ড়ে যাওয়ার শব্দ শোনা যেতো ঘুম ঘর থেকে। তখনো আমরা জাগিনি। মুধুরতম সেইসব ভোর-সকালের গল্প এখনো ফকির বাড়ির মাটিতে জমা আছে। ভুল পড়ছে কেবল স্মৃতিতে। গ্রাম্য সরল মানুষ গুলোর অনেকে এখন নগরে থাকি। নগরে ঘুমাই। জাগি যাতি-যন্ত্রের শব্দের বিকট শব্দে। এখন আমরা সুখের ‘নাগরিক’। বছরে কখনো সখনো হয়তো পাখি দেখি, গান শুনিই না। পাখির গানে ঘুম ভাঙ্গার অভ্যেস সেকেলে হয়েছে সেই কবে। সিসা যুক্ত বাতাসে ভোরের আলো ফুটে এখন। মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি শুনি বিকট শব্দে, বৈদ্যুতিক মাইকে! আজানের চুঙ্গা এখন যাদু ধরেও নেই, অনুমান। সুখ স্মৃতিরা কেবল দূরের বরফ পাহাড়ে চাপা পড়ছে। আর আমরা হারিয়ে যাচ্ছি সময়ের কিনারে। পড়ে গেলেই সমাধিস্থ হবো, মুধুরতম সেইসব ভোর-সকালের গল্প সহ। ফকির পাড়া, দক্ষিণ বাঘা, বাঘা, গোলাপগঞ্জ, সিলেট

অতীতই পাথেয়

চিত্তে থুড়া? অতীত কুড়া। আলু, কদু, মুলা চাষ করতো। স্থানীয় হাটে বিক্রি করতো। একটা মুরগির ডিম চার টুকরো করে জুলিয়ান কাট আলুর ঝুল রাধতো। সুখেই আহার করতো সবাই। ছেলে পুলুরা বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করতো। ঘর প্রধানেরা উক্কা, তামাক, বিড়ি খাইতো। শীতের রাতে কম্বল ছিলো না, ছেড়া কাপড়ের উমে সকাল গুনতো। সূর্য আলো দিলে গায়ে মেখে একখানা কম্বলের স্বপ্ন দেখতো তারা। মানুষগুলো ভালোই ছিলো, ছিলো সরল। দিন বদলে গেছে। তারা সেসব দিন ভুলে গেছে। এখন টাকা নয়; ডলার নাড়ায়। দম্ব নিয়ে ছড়ি ঘুরায় পাড়ায় পাড়ায়। তবে ছিন্ন হয়ে মূল হারিয়েছে। মাথায় এখনো চার ভাগের একখণ্ড ডিমের মগজ। চিত্তে আরো থুড়া। অতীতটা ধরেই আগামী। যারা ধরে তারাই সুন্দর। তারা চিত্তে বিত্তে সমান হয়। যারা অতীত মুছে ফেলতে চায়; বুঝতে হবে গলদ আছে। যারা ইতিহাস মুছে ফেলতে চায়, বুঝতে হবে শেকড়ে ভেজাল আছে। এখানে উল্লেখিত পেশা ছোট কিংবা বড় সেটা বিবেচনা অমূলক। যে যেখানেই যে পেশায় স্বাচ্ছন্দ বোধ করে সেটিই তার জন্য সুখকর। কিন্তু? লেখা: জানুয়ারি ১৪, ২০২৩

Abdul Alim Shah December 31, 2023 No Comments

তরী বাইছি…

দিন যাচ্ছে। কর্ম বদলাচ্ছে। শরিরের ঘর বানাচ্ছে পিঞ্জর কাটা রোগ। বাহু বল কমছে, পা ফেলতে চচ্ছে নিকাশ করে। মাপঝোঁক লাগছে খাবারে। শুয়া বসায় হিসেব। হাটা চলায়ও তাই। সীমিত হচ্ছে সামাজিকতা। কমছে আড্ডার সময়।কমছে আলাপের মানুষ। একই শহরে, একই পাড়ায় থাকছি। কিন্তু দেখা হচ্ছে না। যারা দেশ থেকে দূরে আছে তাদের সাথে সময়ের ব্যবধানে যোগাযোগ নিয়মিত হচ্ছে না। সময় কারাগারে আটকে আছি আমি, আমার যতো বান্ধব। এসবের ফিরিস্ত দিনে দিনে আরও দীর্ঘ হবে। হচ্ছেও তাই। যাক ভালো আছি। সবাই ভালো থেকো এই বেশ। জীবনের তরী নিয়ে শেষ ‘বিশ’ -এ বাইছি সায়রে, সাগরে। কখনো টিলা পাহাড়ে। হইয়্যা হু, হইয়্যা। চলুক। নয়া বছরে সবার জন্য শুভকামনা। যে যেখানে আছো/আছেন- ভালো থাকো/থাকবেন। শুভ ইংরেজি নববর্ষ ২০২৪। #happynewyear2024

Abdul Alim Shah December 31, 2023 No Comments

বিজয় মাস; ২০২৩

বিজয়ের মাস শেষ। জয় বাংলা। জয় বাংলাদেশ। অতৃপ্তি- স্বাধীনতা বিরোধী, রাজাকার, শান্তি কমিটির নেতা, গণহত্যায় নেতৃত্ব দেয়া রক্তে এখনো আস্থা রাখছি! তাদের ঘিরে আমাদের যতো উৎসব! ৭১ -এ তাদের বাবা, কাকাদের নির্যাতনের স্বীকার মানুষেরা ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন এখনো। তারা এখনো নির্যাতিত ওদের দ্বারা। এখনো কি আমরা খোঁজ নিতে পারি গণহত্যার শিকার পারিবার, মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ নিতে পারি আমরা? খোঁজ নেই? দেশ স্বাধীনে স্বাজন হারানো মানুষের খবর রাখি আমরা? রাখি না। স্বাধীনতা বিরোধীদের আশ্রয়ে (বাধ্য হয়ে) তারা ঢুকরে কাদেন। নির্যাতিত হন। প্রতিবাদও করতে পারেন না। অনেক জেলা, উপজেলা, গ্রাম মহল্লার স্বাধীনতা বিরোধীদের সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে। বিজয় মাস আসে, চলে যায়। ইচ্ছে থাকলেও নিজ এলাকার (গোলাপগঞ্জ, সিলেট) শান্তি কমিটির নেতা, রাজাকার, আল বদর, আল শামসদের জানতে পারিনি। এদের কেউ চেনেন না! তাদের উত্তরসূরিদের কেউ চেনেন না! যাক জানবো নিশ্চয়ই। একটু সময় লাগবে হয়তো। আবার বিজয় মাস ফিরবে। প্রত্যাশা, স্বাধীনতা বিরোধীদের রক্ত নেতৃত্ব থেকে মুক্ত হউক বাংলাদেশ। অন্তন একাত্তরে নেতৃত্ব দেয়া রাজনৈতিক দলটি যেনো শান্তি কমিটি (পাক বাহিনীর ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত), রাজাকার, আল বদর, আল শামস ও গণহত্যাকারিদের রক্তবাহি (সন্তান, নাতিপুতি) মুক্ত হয়। ❝প্রগতিশীল❞, ❝মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের❞ এমন ট্যাগ বহনকারী দল, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান সমুহ মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতা করা রাজনৈতিক দলের (জামায়াত) কর্মী মুক্ত হউক। প্রগতিশীলতার আশ্রয়ে ধর্মান্ধরাও চিহ্নিত হউক। জয় বাংলা।

Abdul Alim Shah September 10, 2023 No Comments

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত সবাই কী বন্ধু?

সমাজ কী? ❝যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন মেনে মানুষ সংঘবদ্ধ বসবাস করে। এক বা অধিক গোত্র বা সম্প্রদায় সৃষ্টি করে, সেই ব্যবস্থা বা প্রক্রিয়াকে সমাজ বলে। এটি সমাজ বিজ্ঞানের একটি মৌলিক ধারণা। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাসের উদ্দেশ্য ছিল, নিরাপত্তা ও জীবন ধারণ সহজিকরণ করা। মানব সমাজের আদিম রুপে মানুষ বন্য প্রাণী শিকার ও বন্য ফলমুল সংগ্রহের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। কাল পরিক্রমায় সেই সমাজ বিবর্তিত হয়ে Post modern বা উত্তর আধুনিক সমাজের রুপ নিয়েছে।❞ এই ধারণায় সম্পৃক্ত সবাই সবার সাথে সমাজবদ্ধ। পরিপূরক। প্রয়োজন। জীবন ধারনের সহযোগি। এর মধ্যে কেউ কেউ একই বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায়ের হতে পারে। আবার কেউ কারো সম বর্ণ, গোত্র বা সম্প্রদায়ের নাও হতে পারে। ধর্ম, জাতপাতের ভিন্নতা থাকতে পারে। অভিন্ন জাত, ধর্ম, বর্ণ হলেও কারো কারো মধ্যে ভিন্ন মতাদর্শের পার্থক্য থাকতে পারে। শারিরিক গঠন গাঠনেও ভিন্নতা, মিল থাকা স্বাভাবিক। এদের সবে মিলেই একটি সমাজ হয়। বসবাস ও জীবনাচরণ সহজ করতে সমাজ নির্মাণ করে। সমাজে পরিচালিত হয়। সর্ব ক্ষেত্রে সহনশীলতা, ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহিষ্ণু হতে হয়। সমাজ কাঠামোয় বাধ্যতামূলক না হলেও সমাজবদ্ধ কেউ বা কারা বন্ধু হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু কখনই সমাজে বিদ্যমান সবাই সবার বন্ধু হতে পারে না, হয়ও না। জীবনাচরণের জন্য বন্ধুতা একমাত্র নিয়ামকও নয় বলেই আমি মনে করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কী? যে মাধ্যমের সাহায্যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ একে অন্যের সাথে দ্রুততম সময়ে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে তাই হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এ মাধ্যম মূলত অনলাইন নির্ভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে আমাদের অঞ্চলে Facebook ব্যাপক জনপ্রিয়।❞ মৌলিক ধারণা সমাজ-এর একটি প্রযুক্তি নির্ভর মাধ্যম এটি। এখানেও জীবনাচার সহজীকরণ, নিরাপত্তা ইত্যাদির উপস্থিতি আছে। এ ধারণায় গুরুত্ব দিয়ে যুক্ত করা হয়েছে ‘যোগাযোগ’। সামাজিক মৌলিক নিয়ামক সমূহের সাথে অপরাপর দ্রুত ও সহজে যোগাযোগের জন্য এটি কার্যকর। এখানে সমাজের মতো ভিন্ন মত পথের মানুষের উপস্থিতি আছে। একেবারে তেলে জলে মাখামাখির মতো! সামাজিক নিয়ামক প্রতিপালনের মধ্যদিয়ে এখানে একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে একটি প্রযুক্তি নির্ভর সমাজ নির্মাণ করছেন মাত্র। কিন্তু আমরা এই সমাজ ধারণার প্রযুক্তি মাধ্যমে যুক্ত হওয়াকে মাধ্যমগুলোর স্রষ্টাদের চাপিয়ে দেয়া নিয়মে বন্ধুত্ব বলেই ধরে নিয়েছি, নিচ্ছি। যা কোনভাবেই সমাজ বিজ্ঞানের বর্ধিত ধারণায় সম্পৃক্ত না। এমতাবস্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ততা যৌক্তিক কারণেই বন্ধুত্বের মধ্যে পড়ে না বলেই আমি মনে করি। আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত সাড়ে চার হাজার মানুষের সাথে। কিন্তু আমার মতপ্রকাশে ক্রিয়াশীল মানুষ খুবই নগন্য। শতাংশের হিসেবে ১০ থেকে ১২ শতাংশ। বাকিরা কী করেন? গুপ্তচর ভিত্তি? এদের মধ্যে ভিন্ন মতের মানুষ আছেন, জানি। অভিন্ন মতেরও আছেন। যুক্ততার ১৪ বছরের মাথায় এসে নিকাশ করি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আদতে আমার কোন বন্ধু আছেন কী? নাই। ফলে, সমাজ ধারণার মৌলিক নিয়ামক পর্যালোচনার প্রয়োজন বোধ করি। যৌক্তিক কারণেই বন্ধুত্বের মতো বিশাল সম্পর্ক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের “যুক্ততার” মাঝে গুলিয়ে ফেলছি বিশ্বাস করতে চাই। এখানে সত্যিকার অর্থে সমাজের মতোই জীবনাচরণ ইস্যুতে যোগাযোগ হচ্ছে কেবল, বন্ধুত্ব নয়। “সমাজ” ধারণার নিরাপত্তা যতখানি নিশ্চিত হয় “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের” যুক্ততায় বরং ব্যক্তির নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে যতোখানি বন্ধুত্ব তার চেয়ে বেশি গুপ্তচর ভিত্তি হচ্ছে বেশি। এখানে বর্ণ, ধর্ম, জাতি, দল, উপ-দলীয় বৈষম্য, গোপনীয় গোত্র চর্চা নিরবে হচ্ছে। এর কতোশত প্রমাণ দেখেছি আমরা। তবুও কি যুক্ততা কে বন্ধুত্ব বলে স্বীকৃতি দিব? দিতে পারি না।

বই রাজ্য-সিডনি গণগ্রন্থাগার ও অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন পার্লামেন্ট

সিডনির রৌদ্রজ্জ্বল সকালে গরম চায়ে চুমুক দিতে ভাবছিলাম কোথায় ঘুরতে যাবে।  ক’দিন সঙ্গ দিয়েছেন বন্ধু সহকর্মী শাহাব উদ্দিন শিহাব। আজর তিনি কর্মস্থলে ব্যস্ত। তাই আজ একাই বেরিতে হবে। ক্যান্টারবেরি-ব্যাঙ্কটাউনের লাকাম্বা ট্রেন স্টেশন থেকে ৫৫ মিনিটের পথ সিটি অব সিডনির ম্যাককুয়ারি স্ট্রিট-১ শেক্সপিয়ার পেলেসে রওয়ানা হলাম। ট্রেনে যেতে পথে বানিজ্যক শহর সিডনির গোছানো, সাজানো নগরায়ন দেখছিলাম। ১২ হাজার ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটারের পরিকল্পিত বর্ধমান এই শহর ঘুরে বেড়াতে সড়ক যোগাযোগ, ট্রেন যোগাযোগ, নৌ পথ এমনকি আকাশ পথও হাতের নাগালে। ট্রেনের জানালায় বসে দেখেছি কয়েকটি হেলিকপ্টারের উড়া উড়ি। ২৪০ থেকে ২৫০ অস্ট্রেলিয়ান ডলারে সিডনি শহর উড়ে বেড়ানো যায়। নগরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রেনে চড়ে গন্তব্যে পৌছাই। প্লাটফর্মের ডিজিটাল ডিসপ্লেতে চোখ বুলিয়ে ম্যাককুয়ারি স্ট্রিটে বের হই ভূগর্ভস্থ প্লাটফর্ম থেকে।  প্রথমেই স্ট্রিটের চত্ত্বরে দৃষ্টি আটকায় ভিক্টোরিয়ার স্টেচ্যুতে। ফটো সেশন করে এগিয়ে যাই ৪০০ মিটার অদূরে গন্থাগারের প্রবেশ মুখে। দুপাশে সড়ক। মাঝখানে সেক্সপিয়ার যেন আগতদের স্বাগত জানাচ্ছেন। হেনরী গুলেট (Henry Gullett) ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে এটি স্থাপন করেন। ছ’টি সুউচ্ছ খিলানের ছাউনি তলে প্রবেশদ্বারে আগত যেকেউ সম্ভাষন পাবেন স্থাপথ্য ভাষায়। গণ গ্রন্থাগারে প্রবেশ করলাম। বিশাল পড়ার ঘর। চারিদিকে বই আর বই। শত পাঠক, গবেষক টেবিলে টেবিলে। দ্বিতল কক্ষের দেয়াল ঘেষা সিঁড়ি। উপরের বইগুলোও যেন সহজে পরখ করতে পারেন পাঠকরা। নিস্তবদ্ধ, নিরবতায় পড়ুয়ারা মগ্ন। আমি রেকে রাখা বইগুলো দেখতে ধীরে ধীরে হাটছি। মেজেতে মখমল বিছানো। তবুও যেন পায়ের শব্দ কানে আসছে। হাজারে হাজার বইয়ে হারিয়ে যাচ্ছিলাম।  কোথায় কি আছে দেখতে অর্থ্যাৎ একনজর দেখে নিলাম বই রাজ্য। কোন কোন বই নেই এখানে? বিস্মিত। এতো বড় বইয়ের রাজ্য আমি আগে দেখিনি। আগেই যেনে নিয়েছিলাম, এখানে ফ্লাস লাইট ছাড়া ছবি, ভিডিও তোলা যাবে। তাই দু একটা ছবি তোলে নিই। এবার সেক্সপিয়ার গ্যালারীতে। উলিয়াম সেক্সপিয়ারের আবক্ষ মুর্তি দিয়ে প্রবেশদ্বার সাজানো। ছবি, লেখাজুখা কতো বিরল সব উপস্থাপনা। গ্যালারী ঘুরে দেখতে যেকোন পর্যটকের অনন্ত ঘন্টাখানেক সময়তো লাগবেই। আমি প্রবেশ করেছিলাম সাড়ে বারোটায়। শুধু একপল দেখে দেখে বেরিয়েছি বিকেল সাড়ে চারটায়। শুধুমাত্র পড়ার ঘর আর গ্যালারীতে কেটেছে পুরোটা সময়। দেখেছি শত শত বছরের পুরোনো ইতিহাসের নিদর্শন সমূহ। অস্ট্রেলিয় সংস্কৃতির আদিকাল থেকে আধুনিক। সিডনি ভ্রমনে এসে গ্রন্থাগারে না আসতে পারলে ঠকে যেতাম। পড়ন্ত বিকেলে গ্রন্থাগার থেকে বেরিয়ে আসি। তখন প্রচন্ড খিদে। সড়কের ওপারে যাই, খাবারের দোকানে। ততক্ষনে পাচঁটা ছুঁই ছুঁই। দোকানিদের বেলা শেষ। ব্যবসা বন্ধের তাড়াহুড়ো চলছে। বইয়ের গন্ধে সারাদিন খাবোরের কথা মনে না পড়লেও এখন যেন তর সইছে না। কয়েকটি দোকানে খোঁজাখুজির পর ভ্রাম্যমান গাড়িতে সিঙ্গেল শট এক্সপ্রেসোতেই মুখ বদলাই। ভিক্টোরিয়া স্টেচ্যুর সামনের বিশাল বৃক্ষ তলে কফি কাপেই সন্ধ্যা নামে। সামনে কতো মানুষের দৌড়ঝাপ। গাড়িতে, ট্রেন স্টেশনে যাবার তাড়া। সবই দেখছি, কিন্তু ঝাপসা। চোখে গ্রন্থাগারের আবেশটা যেন যাচ্ছেই না। হয়তো দেখা নয়; নিয়ম করে প্রতিদিন একবার পড়ার ঘরে আসলেও বইয়ের বিশাল এই রাজ্য জয় সম্ভব নয়। তৃষ্ণা রেখেই ফিরলাম। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে কেউ যদি ভ্রমনে আসেন, আপনার ভ্রমন তালিকায় ‘পাবলিক লাইব্রেরী অব নিউ সাউথ ওয়েলস’ রাখবেন। নিশ্চিত করেই বলছি- ঠকবেন না। জিতেই ফিরবেন।  গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা ‘অস্ট্রেলিয়ান সাবস্ক্রিপশন লাইব্রেরী (Australian Subscription Library) ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে পিট স্ট্রিটে (Pitt Street) ভাড়া ভবনে এর যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী দুই বছর গ্রন্থাগারটি ভ্রাম্যমান সেবা প্রদান করে। পরে বেশ কয়েক বছর জর্জ স্ট্রিটে, ব্রিজ স্ট্রিট, ম্যাককুয়ারি স্ট্রিট এবং ম্যাককোয়ারি প্লেসে গ্রন্থাগারটি স্থানান্তরিত হয়। শেষমেষ ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বেন্ট এবং ম্যাককুয়ারি স্ট্রিটের (Bent and Macquarie Streets) নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হয়। অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীনতম গ্রন্থাগার ‘নিউ সাউথ ওয়েলস স্টেট লাইব্রেরী’। নানা সমস্যায় গ্রন্থাগারটির অচলাবস্থায় পড়লে ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে নিউ সাউথ ওয়েলস সরকার ‘অস্ট্রেলিয়ান সাবস্ক্রিপশন লাইব্রেরীটি (Australian Subscription Library) কিনে নেয় এবং নামকরণ করা হয় পাবলিক লাইব্রেরী অব নিউ সাউথ ওয়েলস/দি স্টেট লাইব্রেরী অব নিউ সাউথ ওয়েলস (The State Library of New South Wales)। দেশের প্রথম এই গ্রন্থাগারটি দুই হাজার পুস্তক নিয়ে নব যাত্রা শুরু করে। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় গ্রন্থাগারটির উন্নয়ন করা হয়। মিচেল উইং ও ডিক্সন উইং নামের দুটি ভবনে বিস্তৃত হয় এটি। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রিন্স ফিলিপের ( Prince Philip) সাথে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ (Queen Elizabeth-II) গ্রন্থাগারটির নতুন সংযোজনের উদ্বোধন করেন। স্থপতি মি.  অ্যান্ড্রু অ্যান্ডারসন (Mr Andrew Andersons) এবং ওয়াল্টার লিবার্টি ভার্নন (Walter Liberty Vernon) ছিলেন গ্রন্থাগারটির স্থপিতি। এখানে রয়েছে প্রদর্শনী গ্যালারী, রিডিং রুম, বইয়ের দোকান, শেক্সপিয়ার রুম, লাইব্রেরী ক্যাফে, ফ্রেন্ডস রুম, ও লাইব্রেরী বার। বিভিন্ন গ্যালারীতে ১২ ৭৬ টি পেইন্টিং, মানচিত্র রয়েছে ৩০২টি এবং ২৪ ৭৩৫টি ছবি সংগ্রহে রয়েছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, গবেষনা, বিশ্বযুদ্ধ সহ নানা বিষয়ে বিশাল সংগ্রহ গ্রন্থাগারটিকে সমৃদ্ধ করেছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ও প্রাচীনতম পার্লামেন্ট আপনার হাতে সময় থাকলে একই দিনে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ও প্রাচীনতম পার্লামেন্ট দেখে আসতে পারেন। সকাল ৯ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। গণগ্রন্থাগারের পরেই সিডনি হাসপাতাল, এর পরের ভবনটিই ঐতিহাসিক ‘দি রাম হসপিট্যাল’। আপনি নিজের পরিচয় দিয়ে নির্ধারিত নিরাপত্তা চৌকি পেরিয়ে পার্লামেন্টে প্রবেশ করতে পারেবন। ইনফরমেশন ডেস্কে পার্লামেন্ট সর্ম্পকিত সকল তথ্য পাবেন। আমি পার্লামেন্ট ভবনের বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইছিলাম। ফলে আমাকে একজন কর্মকর্তা পুরো ভবনের কোথায় কি আছে ঘুরে দেখান এবং বিষদ বর্ণনা করেন। তবে, পার্লামেন্টের আভ্যন্তরিক কিছু আইন কানুনের কারণে আমি সব কক্ষে প্রবেশানুমতি পাইনি। ১৯ জুলাই ২০২৩ তারিখে নির্ধারিত কোন সভা না থাকায় ঘুরে দেখাটা সহজ হয়। এখানে ভ্রমনের ক্ষেত্রে কোন ধরণের ফি প্রদান করতে হয় না। পার্লামেন্ট কার্যালয়ের কর্মকর্তারা খুবই আন্তরিক। তারা আপনার এবং আপনার দেশ সর্ম্পকে জানতে চাইতে পারে। নিউ সাউথ ওয়েলসের পার্লামেন্ট। এটি অস্ট্রেলিয়ার প্রথম এবং প্রাচীন পার্লামেন্ট। প্রতিষ্ঠাকালীন ভবনের কিছু অংশ এখনও সংরক্ষিত আছে। সিডনিতে ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। নিউ সাউথ ওয়েলসের তৎসময়ে গভর্নর ছিলেন লাচলান ম্যাককুয়ারি (Governor Lachlan Macquarie)। তখনও এখানে স্থায়ী হাসপাতাল সুবিধা ছিলও না। তিনিই সিডনিতে প্রথম স্থায়ী হাসপাতাল পরিচালনা করেন, এর কার্যক্রম শুরু ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে। হাসপাতালটি নির্মাণ করতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ষাট হাজার গ্যালন ‘রাম’ আমদানি ও বিক্রির অনুমতি দেয়া হয়। এ কারণে হাসপাতালটির নামকরণ করা হয় ‘দ্য রাম হসপিট্যাল’। প্রতিষ্ঠাকালীন মূল ভবনের দুটি অংশ টিকে আছে যা বর্তমানে নিউ সাউথ ওয়েলস-এর পার্লামেন্টের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে শাসকরা গভর্নরকে সহায়তা করতে এ রাজ্যে একটি আইনসভা গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি ছিলও নিউ সাউথ ওয়েলস-এর গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার প্রথম ধাপ। ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত। সে সভায় পাঁচ সরকারী কর্মকর্তা অংশ নেন। ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে আইনসভা বর্ধিত করা হয়। নিউ সাউথ ওয়েলসে গণতন্ত্রের বিকাশ ও পার্লামেন্ট ভবনের কার্যকর ভূমিকা রাখতে করে। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে পূনঃনির্মাণ করে ১২ তলা বিশিষ্ঠ ভবনে রূপান্তর করা হয়। বর্তমান পার্লামেন্টে বিধানসভা, আইন পরিষদে রাজ্যের ৯৩টি জেলার প্রতিনিধি রয়েছেন এবং ২৩ জন মন্ত্রী সরকারের দায়িত্ব পালন করছেন।   আব্দুল আলিম শাহ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

অপেরা-হারবার; প্রশান্ত পাড়ের প্রশান্তি

ছোট বেলায় ক্যালেন্ডারের পাতা, পোস্টার-স্টিকারে ‘সিডনি অপেরা হাউস’ ও ‘ডার্লিং হারবার ব্রিজ’ এর কত্তো ছবি দেখেছি। সময় আন্তাজ নেই। তবে, ছবিগুলো মনে গেঁথে আছে আজও। ভাবতাম- যদি স্থাপনাগুলোর সামনে কখনও দাঁড়াতে পারতাম। স্বচক্ষে দেখতে পারতাম বিশ্ব ঐতিহ্যের নিদর্শনগুলো। কেমন অনুভূতি হতো? জারপরনাই সুখি হতাম। বড় হতে হতে ভাবনাগুলো স্বপ্নে পরিনত হয়। স্বপ্নগুলোও বড় হতে থাকে। এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমনের সুযোগ হয়। ভ্রমনের দ্বিতীয় দিনেই চলে আসি অপেরা হাউজ, হারবার ব্রিজে। সাগরের হীম হাওয়ায় শুনি সেই ছোট বেলার স্বপ্ন কথা। কানে ভাসে সে সময়ের ভাবনাদের শব্দ। আর স্থাপথ্যের ভাষায় দেখি প্রশান্ত পাড়ের স্বপ্নদের। কি অদ্ভুত অনুভূতি, ভালো লাগায় ডুবে যাই। ভাবনার, স্বপ্নের শেষ হয়ে যায় এক মুহুর্তেই। ১৭ জুলাই ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ। গোধূলী লগ্ন। প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলে সূর্য্যাস্তকাল। একটু পরেই আধাঁর নামবে। পশ্চিমাকাশের সোনালী আভায় সাগরের নীল জল রং বদাচ্ছে প্রতিমুহুর্তে। ‘ডার্লিং হারবার ব্রিজ’ কালের কালি মুছে উপস্থাপনায় দৃড় হয়ে উঠছে। এ যেন এক নব নির্মাণ। নিজস্ব রং, বয়স ছাপিয়ে  অন্য রূপ ধারণ করছে স্থাপনাটি। যখন মেঘাকাশের তলে সিডনি আধাঁরের হারাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন হারবার দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। ভিন দেশিদের নজর কাড়তে রং ছড়াচ্ছে জল-আকাশের তলে। অদূরে সমুদ্র জলে জলকেলিতে হাতছানি দিয়ে ভ্রমনার্থীদের ডাকছে অপেরা হাউজ। নিজস্ব স্থাপথ্য গৌরবে মুগদ্ধ করছে অপেরার নৌ রূপ। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের প্রধান শহর সিডনি। প্রাচীন এই শহর রাজ্যের রাজধানীও। সিডনির অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র অপেরা হাউজ। এর অবস্থান সিডনি সমুদ্র বন্দরের বেনেলং পয়েন্টে। এই বন্দরের নাম আগে ছিলও ম্যাককুইরি বন্দর। নৌকার পাল আকৃতির অপেরা হাউজটি পর্যটকদের আকর্ষণের শীর্ষে রয়েছে। ইউনেস্কো’র বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দেে এটি যুক্ত হয়। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে অপেরা হাউজের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ড্যানিশ স্থপতি জর্ন উটজনের (Architect Jørn Utzon) হাতেই। নির্মাণ ব্যয়বহুল ও স্থপতি উটজনের নকশা ত্রুটি কারণে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রকল্পের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। পরে পিটার (Peter) নামের এক স্থপতি অপেরা হাউজের ত্রুটি সংশোধন করে নির্মাণ কাজ শেষ করেন। রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ২০ অক্টোবর, ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে আধুনিক স্থাপত্যে এ নিদর্শন উদ্বোধন করেন। অপেরা, হারবার ব্রিজের সৌন্দর্য্য উপভোগে স্বপ্নের কাছাকাছি দাঁড়াই। অনুভূতি কেমন ছিলও তখন? বুঝাবার সুযোগ খুবই কম। শুধু চোখে ভাসছিল ছোট বেলার ক্যালেন্ডারে ছবিগুলো। আর নিজের চোখে মিলিয়ে দেখছিলাম অপেরা-হারবারের স্থাপথ্য। গুলমেলে লাগছিল, ছানাবড়া চোখে এদিক ওদিক দেখছিলাম। প্রকৃতি আর আধুনিক স্থাপথ্যের সম্মিলন ম্যাজিকমুমেন্ট শেষ হলে হয়তো বিলিন হবে সেই তাগিদ ছিলও। দ্রুতই কাটে মুগদ্ধতার সময়গুলো। স্থাপনাগুলোর অবস্থান, স্থাপথ্য নকশার অভিনবত্ব আর সাগর প্রকৃতি- সব মিলিয়ে স্বপ্ন যেনো হাতের মোঠোয় ছিলও খানিক সময়। অপেরা আর হারবার ব্রিজের দুপাশের পাহাড়ি বসতিগুলোও সিডনির পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ। অপেরার প্রবেশ পথের সমুদ্র ঘাট থেকে ছোট ছোট জলতরিতে সাগর চ্যানেলে ভ্রমনের সুযোগ রয়েছে। দুপাশের পাহাড়গুলোয় গড়ে উঠা বসতির দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন ভ্রমনকারীরা। আমি অবশ্য সে সুযোগ নিতে পারিনি, সময়ের স্বল্পতায়। অপেরা হাউজের পশ্চিম পাশ থেকে হারবার আর পূর্ব থেকে অপেরার প্রেমেই আটকে ছিলাম। সামনের বিশাল খোলা জায়গা ধরে নৌকাকৃতির অপেরার সবদিকে হেটেছি। ভিন্নতর দৃশ্যে নির্মাণ রহস্য, সংস্কৃতির মেলবন্ধন খোঁজেছি। গোধূলী বেলায় আপনিও আসলে এবং রৌদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া থাকলে আপনিও আপ্লুত হবেন। বানিজ্য শহর সিডনির ঐতিহাসিক স্থাপনা সমূহের পাশের বহুতল ভবনগুলোও যেন এই লগ্নে নিজেদের মেলে ধরছি। গোধূলী আলোর সব রং যেন ধারণ করছিলও ভবনগুলোর গায়ে। দেখে মনে হয় পুরো এলাকায়টাই যেন সূর্য্যাস্তকালের অপেক্ষায় ছিলও সারাদিন। ভবনগুলোর কাঁচের গায়ে আকাশের হারিয়ে যাওয়া আলোরা এসে আসন পেতে বসে। আর সেই আলোয় বন্দর এলাকাকে আলোকিত করে তুলে। সিডনি হারবার ব্রিজ নির্মাণ শুরু হয় ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে। নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯ মার্চ ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে। ঐতিহাসিক এই ব্রিজটির উচ্চতা ৪৪০ ফুট। ব্রিজটির দৈর্ঘ্য ৩৭৬৬ ফুট। পোর্ট জ্যাকসনে স্টিলের তৈরী ব্রিজ। এটি বিশ্বের দীর্ঘতম স্টিল-আর্ক ব্রিজের অন্যতম। ব্রিজটিতে রয়েছে চারটি রেলপথ, একটি মহাসড়ক এবং দুটি পায়ে হাটার পথ। আজকের ভ্রমণ তালিকায় অপেরা হাউজ এবং হারবার ব্রিজই ছিলও। আলো ঝলমলে রাতের সৌর্ন্দয্য দেখতে দেখতে কফি কাপের সঙ্গ নিই। প্রশান্ত মহাসাগরের হিমেল হাওয়া আর কফির তেতো স্বাদে অপেরা-হারবারের বর্ণিল রূপ সৌন্দর্য্য বিশাস শেষ হয়। ঐতিহ্য আর ঐতিহাসিক স্থাপনা ভ্রমন পর্বে সাথে ছিলেন স্বদেশি সহকর্মী শাহজাহান সেলিম ও ইদ্রিছ আলী। একটি সন্ধ্যা, একটি গোধূলী বেলায় প্রশান্ত পাড় থেকে প্রশান্তি নিয়েই ফিরছিলাম ট্রেনে চড়ে। ভ্রমনকারীরা সিডনি এলে ভ্রমন সূচীতে অপেরা হাউজ ও হারবার ব্রিজ রাখতে পারেন। সিডনির যেখানেই আপনার থাকার ব্যবস্থা থাকুক, আপনি বাস, ট্রেন অথবা প্রাইভেট কারে যেতে পারবেন। স্থান বেঁধে সময় যাতায়াত খরচ হবে। তবে, সময় নিয়ে গেলে সবচেয়ে কম খরচ পড়বে ট্রেনে। ট্রাভেল কার্ড নিয়ে নিলে খুবই অল্প খরচে ঘুরে আসতে পারবেন। সিডনি, অস্ট্রেলিয়া থেকে আব্দুল আলিম শাহ | ১৭ জুলাই ২০২৩

ত্রয়ী প্রেমের নীল কাব্য; থ্রি সিস্টার্স

মেহনি (Meehni), উইমলা (Wimlah) ও গুনেডু (Gunnedoo) এরা তিন বোন। সৌর্ন্দয্য অতুলনীয় ছিলও তারা। তাদের নিয়ে নানা পৌরানিক গল্প আছে দ্বীপ মহাদেশ অস্ট্রেলিয়ার আদি ইতিহাসে। আদিমকালের এই ত্রয়ীর গল্প রহস্য ঘেরা। সুন্দরী রূপবতি এই ত্রয়ীর প্রতিবেশি ছিলও উপজাতি এক পরিবারে তিন সহোদর। তাদের নাম-দাম ইতিহাসে আজও অজানা। তবে, তাদের বসবাস ছিলও নীল পর্বতমালায় (Blue Mountains)। পৌরানিক গল্পের অজানা নায়করা আদিমতায় হারিয়ে গেলেও, সুন্দরী তিন বোনের এখনও দৃশ্যমান। নীল পর্বতে পাথর রূপে তারা এখনও অমলিন। শুধু বদলেছে গায়ের আবরণ। তারা এখন পাথুরে আকৃতি নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে আছেন! অস্ট্রেলিয়ার পৌরানিক গল্প অনুসারে, মেহনি, উইমলা ও গুনেডু- রূপবতি তিন বোন নীল পর্বতের বাসিন্দা উপজাতি তিন সহোদরের প্রেমে পড়েন। তাদের প্রেমের সর্ম্পক জানাজানি হয়। অসম প্রেম কাহিনী বলে খ্যাত হয় তাদের সে সর্ম্পক। তখনকার সময়ে উপজাতি সংস্কৃতির রীতিনীতিতে যা ছিলও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ৩ বোনের প্রেমের করুণ উপাখ্যান তৈরী হয়। মধুরতম প্রেমের বদলে সৃষ্টি হয় এক রক্তক্ষয়ি প্রেমকাহিনী। পর্বত জুড়ে বেদনার করুণ সুর উঠে। কি হয়েছিলও তখন? নীল পর্বতের বাসিন্দা মেহনিদের প্রেমে প্রাথমিক জয় হয়েছিল প্রতিবেশী উপজাতি গোত্রের তিন সহোদরের। কিন্তু প্রথা বিরোধী হওয়া  ভিন্ন গোত্রের মানুষের সাথে সর্ম্পক বাঁধার মুখে পড়ে। কিন্তু প্রেম কি বাঁধা মানে? মানে না। তাই তিন সহোদর মেহনিদের জোর পূর্বক উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্ঠা করেন। এই ঘটনায় দুই গোত্রের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাঁধে! সংঘর্ষ থামানোর কি উপায়? মেহনীদের গোত্রে এক যাদু বিদ্যান ছিলেন। জীবন রক্ষায় তিনি মেহনিদের জ্যামিসন উপত্যকার চুঁড়ায় নিয়ে যান এবং যাদু শক্তিতে মেহনিদের পাথরে রূপ দেন। তাতে তারা নিরাপদ হয়। সংঘাত থামলে তাদেরকে পূনরায় মানুষ রূপে ফিরিয়ে আনবেন এমন প্রত্যয় ছিলও। কিন্তু গোত্রদ্বয়ের মধ্যে তখনও সংঘাত চলছিলও। তিনি গ্রামে ফিরে আসেন। সেই সংঘাতেই আহত হন  যাদুকর। তিনি মারা যান। মেহনিদের আর মানুষ রূপে ফিরি আসা হয়নি। সেই থেকে তারা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীল পর্বতের জেসমিন ভ্যালিতে। বেদনার নীলে ঘিরে যায় পুরো পর্বতমালা। চারপাশের পাহাড়গুলো নীলাকার হয়ে উঠে। অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের আর কোথাও নীল পাহাড় নেই। অজিদের  বিশ্বাস- মেহনিদের বেদনার প্রতিক হয়ে পৃথিবীকে স্বাক্ষ্য দিচ্ছে নীল পর্বতের পাহাড়গুলো। নীল পর্বতের জেসমিন ভ্যালির চুঁড়ায় পাথুরে যে তিনটি ক্ষয় প্রাপ্ত পর্বত খন্ড দেখছেন এরাই অস্ট্রেলিয়ার পৌরানিক গল্পের তিন বোন! যা এখন থ্রি সিস্টার্স নামে পরিচিত। এটি বর্তমানে সিডনির বিখ্যাত একটি পর্যটন কেন্দ্র। আদিম থেকে আধুনিকতায় মেহনিরা উজ্জ্বল হয়ে উঠেন। নিজেদের সৌন্দর্য্য বিলিয়ে ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছেন পাথুরে ত্রয়ী। তিন বোনের প্রেমের শেষ পরিনতি হয়ে থাকলো থ্রি সিস্টার্স। তাদের প্রেমের করুন সুর এখনও বিশ্ব হৃদয় কাঁদায়। বিশ্বের যেকোন প্রান্ত থেকে ভ্রমনকারী সিডনি আসলে থ্রি সিস্টার্স দেখতে ভুল করেন না। মুগদ্ধ হন পাথর হয়ে যাওয়া মেহনিদের সৌর্ন্দয্যে। আমিও দেখে সেই বেদনার নীল, নীলা পর্বত চুঁড়া। থ্রি সিস্টার্স-এর প্রাকৃতিক গঠণ থ্রি সিস্টার্স-এর অবস্থান অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের কাটুম্বা শহরবর্তি নীল পর্বতমালার জেমিসন ভ্যালিতে। প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে ‘ট্রায়াসিক’ আমলে ভূমি ক্ষয় হয়ে গড়ে উঠে ‘থ্রি সিস্টার্স’ (Three Sisters)। নীল পর্বতমালার বেলেপাথর প্রচন্ড বাতাস, ভারি বৃষ্টি আর পর্বতমালার খরস্রোতা নদীর তুড়ে ক্ষয় হতে শুরু করে। সেসময় জেমিসন উপত্যকার চারপাশের পর্বতগুলোতে ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দেয়। এক পর্যায়ে পর্বতমালার অংশ বিশেষ সমুদ্র জলে তলিয়ে যায়। প্রাকৃতিক সেই গঠন-পূর্ণগঠনে মহাসাগরের তলে একটি পলল স্থর গড়ে উঠে। সেখানে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট উপাদান সমূহ ভূমিক্ষয় প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয়ে বেলেপাথরে রূপ নেয়। এক সময় সেই বেলেপাথরের স্থরে শক্তিশালী আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হয়। এর ফলে পর্বতমালায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়। থ্রি সিস্টার্স সেই পারিবর্তনেরই এক রূপ। থ্রি সিস্টার্স এর উচ্চতা অনুযায়ি তিন বোনের নামে নামায়ন করা হয়। ৩০২৫ ফুট উচ্চতার পাথরটির নাম মেহনি (Meehni)। উইমলা’র (Wimlah) উচ্চতা ৩০১২। ফুট আর গুনেডু’র (Gunnedoo) উচ্চতা ২৯২৮ ফুট। রুক্ষ পর্বতমালার আর্শ্চয্য এই প্রাকৃতিক দৃশ্যে দেখতে প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ভ্রনম পিপাসুরা আসেন। ৩৯০০ ফুট উচ্চতার নীল পর্বতের পিক পয়েন্ট থেকে এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়। এখানে আসলে রুক্ষ খাড়া পর্বত চুড়ায় মেঘের দৌড়ানি দেখে যেকেউ মুগদ্ধ হবেন। পর্বতমালার দূর সীমানায় সূর্য্যালোকের পরিবর্তনের ফলে রূপ বদলায় ক্ষনে ক্ষনে। একইভাবে থ্রি সিস্টার্সে রূপ রং বদলায়। একেক আলোয় একেক রূপে ধরণ করে। তবে, মেঘলা আবহাওয়ায় এখানকার পরিবর্তন  ভ্রমনার্থীদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষনীয়। এছাড়া, খাড়া রুক্ষ পাহাড়, ইউক্যালিপটাস বন, জলপ্রপাত, পাহাড়ী গ্রাম দেখার অভিজ্ঞতা নিতেই পারেন যেকোউ। সেক্ষেত্রে অবশ্য নীল পর্বতের অন্তত একরাত থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আসতে হবে। সিডনি থেকে নীল পর্বত যাবেন কিভাবে? রেল, বাস ও প্রাইভেট কারে যেতে পারেন সিডনি শহর থেকে ১১২.৬ কিলোমিটার দূরত্বের পর্যটন কেন্দ্রে। ট্রেনে দেড়’শ অস্ট্রেলিয়ান ডলার খরছে ট্রেনে যেতে সময় লাগবে আড়াই থেকে ৩ ঘন্টা। একই পরিমান সময়ে বাসে যেতে খরচ হবে একশ ত্রিশ থেকে একশ চল্লিশ ডলার। তবে সময় বাঁচাতে চাইলে প্রাইভেট কার ভাড়া করে দেড় ঘন্টায় পৌছাতে পারেন। আব্দুল আলিম শাহ | সিডনি, অস্ট্রেলিয়া